স্বাধীন বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের সব থেকে যুগান্তকারী এবং ভূমিকা রাখেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ জিয়া তার উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী সমাজকে এতে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেন।নারী-পুরুষ সমভাবে অংশগ্রহণের কথাও আমাদের সংবিধানে বলা থাকলেও ‘ ৭১ পরবর্তী বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্নরূপ।
স্বাধীনতার পর জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করার মতো ছিল না। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকার ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করলেও এর ব্যাপ্তি ছিল খুবই সীমিত। শহীদ জিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণে উল্লেখ বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। কিন্তু সেই নারী সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থকরী কার্যাবলিতে, জাতি ও সমাজ গঠন ব্যবস্থায় পুরুষদের তুলনায় অনেক পশ্চাতে পড়ে রয়েছে। পূর্বে তাদের চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য কোনো সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয় নাই। ঘর-কন্নার কাজ ছাড়া আর কোনো অর্থকরী বা গঠনমুখী কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এই কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যদি কোনো জাতির অর্ধেক অংশ পেছনে পড়ে থাকে, তবে সেই জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি আশা করা যায় না। বর্তমান সরকার এ সমস্যাটি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে এবং আমাদের নারী সমাজের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সমাজ ও জাতি গঠনে তাদের সমান সুযোগ দেওয়ার কাজে সচেষ্ট হয়েছে এবং তার জন্য বিভিন্ন বাস্তবমুখী কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে।’ (দৈনিক বাংলা, ৩ এপ্রিল ১৯৭৯)
জিয়াউর রহমান তার ঐতিহাসিক ১৯ দফার ১১ নম্বর দফায় নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করে এবং সমাজে তাদের যোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। নারীর কল্যাণ ও তাদের অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে একটি নারীবিষয়ক দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের সরকার ‘মহিলাবিষয়ক’ একটি স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৮-৮০ সালের জিয়া সরকারের গৃহীত দ্বিবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। জাতীয় মহিলা সংস্থা ও নারী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে নারীদের সেলাই, বুনন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং মৌচাষ ইত্যাদি নানামুখী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের কর্ম উপযোগী করে তোলা হয়। বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন নারীদের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে নারীদের কল্যাণে আইডিএ ও বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছিল।
নারী শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষিত নারীদের কর্মজীবী নারীতে রূপান্তরিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে চাকরির শূন্য পদে নারীদের জন্য শতকরা ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন জিয়াউর রহমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নারীদের বিশেষ প্রাধিকার প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক স্কুলে নারীদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ, সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে এক-তৃতীয়াংশ, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্ট ও করণিক পদের শতকরা ৫০ ভাগ, টেলিফোন অপারেটর ও রিসেপশনিস্টের সব পদ এবং থানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের ২০ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। মেডিক্যাল কলেজসমূহের ২০ শতাংশ আসন নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। (The Bangladesh Observer, 25 Dec. 1980) বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে আজ যে নারী সদস্যের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায় এর উদ্যোগটি প্রথম নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনিই প্রথম সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা উপেক্ষা করে নারীদের পুলিশ বাহিনী যোগদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামীণ জনপদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহীদ জিয়া গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি প্রতিষ্ঠা করেন। এতেও তিনি নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কর্মজীবী মহিলাদের সুবিধার্থে তিনি প্রথম মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল নির্মাণের ব্যবস্থা করেন । অনেক কর্মজীবী মহিলারা এতে উপকৃত হয়েছেন এবং চাকরিকালে তাঁদের বাসস্থানের সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়। তিনি নারী সমাজকে স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতেন যে মেয়েরা নিজেরা যদি উপার্জন ক্ষম হয়, তাহলে সেই পরিবারের সকলের কাছে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যাবে এবং নারীদের উপর অযথা হয়রানি ও অত্যাচার কমে যাবে।
নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতেন বরাবরই। রাজনীতিতে নারীরা যেন অধিকহারে সম্পৃক্ত হতে পারেন সে লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সভায় বক্তৃতায় তিনি কেন্দ্র, জেলা এবং আরো নিচের পর্যায়ের কমিটিতে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন ‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নারী একদিন না একদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য হবেন।’
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ১০ বছরের স্থলে ১৫ বছর এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ জন করেন। এর বাইরে সংবিধানের ৬৫(২) অনুযায়ী সাধারণ আসনেও নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। মন্ত্রিপরিষদেও জিয়া নারী সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৯৭০-৭৫ সালের সরকারে নারী মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২ জন। ১৯৭৬-৮০ সালে জিয়া সরকারের সময় এ সংখ্যা ৬ জনে উন্নীত হয়। শহীদ জিয়া স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থায় নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকারের যোগাযোগ তৈরির জন্য তিনি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বাল্যবিয়ে বন্ধ, যৌতুক নিরোধ ও নারী নির্যাতন বন্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এ কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও গ্রাম সরকারকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে বিবাহে যৌতুক নিরোধ আইন পাস করা হয়। জিয়ার এসব উদ্যোগের ফলে তখন নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক কমে গিয়েছিল। জনসংখ্যা বাড়ানোকে বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৭৬ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে প্রায় ৫৫ হাজার পূর্ণকালীন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন নারী কর্মী। পরিবার পরিকল্পনার কথা এই দেশে এক সময় ভাবাই যেতো না। অথচ জিয়া আগামীর সমস্যা সবাইকে বুঝিয়ে এই দেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প হাতে নেন। মিশরের গ্র্যান্ড ইমামকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন দেশে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন নাজায়েজ নয়, তা বিস্তারিত বুঝিয়ে ছিলেন অতি রক্ষণশীলদের।
প্রায় প্রতিটি জনসভাতেই তিনি মেয়েদেরকে উপদেশ দিতেন যেন তারা স্বাবলম্বী হয়, কোন না কোন কাজ করে যেন তারা সংসারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে সেইসব পরামর্শ দিতেন। তিনি বলেছিলেন “আপনারা জেগে উঠুন; আপনারা আমাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনারা সক্রিয়ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করুন ,আপনাদের স্বামীদেরকেও বাধ্য করুন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য” ।
তাই দূরদর্শী ক্ষণজন্মা এই জনপ্রিয় নেতা জিয়াউর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারীবাদী নেতা।